ছন্নছাড়া ফিল্ডিংয়ের পর ব্যাটিং ব্যর্থতায় বাংলাদেশের হতাশার হার
দ্রুত একটি রান নেওয়ার চেষ্টা করছিলেন নিগার সুলতানা। কিন্তু ক্রিজে পৌঁছানোর কাছে গিয়ে যেন নিজেকে হারিয়ে ফেললেন বাংলাদেশ অধিনায়ক। ব্যাটই নামাতেই ভুলে গেলেন তিনি। আগেই অ্যানাবেল সাদারল্যান্ডের থ্রো ধরে স্টাম্প ভেঙে দিলেন অ্যালিসা হিলি। নিগারের ওই গা ছাড়া ভাবের রান আউটে মিশে থাকল যেন গোটা দলের পারফরম্যান্স।
নিগারের আগে রান আউটে কাটা পড়েন বাংলাদেশের আরও দুই ব্যাটার। ফিল্ডিংয়ের সময় ক্যাচ হাতছাড়া ও মিস ফিল্ডিংয়ের পসরা সাজিয়ে বসেন তারা। ব্যাটিংয়ে কিছুটা লড়াইয়ের ছাপ রাখলেও শেষ পর্যন্ত নামে ধস। সব মিলিয়ে প্রাপ্তি বাজে হার। বোলিংয়ে দারুণ শুরুর পরও অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে প্রথম ওয়ানডেতে বড় ব্যবধানে হারল বাংলাদেশ।
মিরপুর শের-ই বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে বৃহস্পতিবার ১১৮ রানে জিতেছে অস্ট্রেলিয়া। বিশ্ব চ্যাম্পিয়নদের ২১৩ রানের জবাবে ৮৪ বল বাকি থাকতেই ৯৫ রানে গুটিয়ে গেছে স্বাগতিকরা।
রান তাড়ায় এক পর্যায়ে ২ উইকেটে ৭০ রান ছিল বাংলাদেশের। সেখান থেকে তারা ২৫ রানের মধ্যে হারায় শেষ ৮ উইকেট।
ওয়ানডেতে বাংলাদেশের এর চেয়ে বড় ব্যবধানে পরাজয় আছে আর দুটি। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ২১৬ ও ১৫৪ রানে।
শক্তি-সামর্থ্যের দুই দলের পার্থক্য এমনিতেই বিশাল। বাংলাদেশ জয় পেলে তাই চমকই হতো ক্রিকেট বিশ্বের জন্য। সেই প্রছন্ন সম্ভাবনাও দেখা যায় ম্যাচের শুরুতে। দলীয় পঞ্চাশের আগেই ৪ উইকেট হারায় অস্ট্রেলিয়া। ৭৮ রানে পড়ে তাদের পঞ্চম উইকেট। সেখান থেকে অ্যাশলি গার্ডনার, সাদারল্যান্ড ও অ্যালানা কিংয়ের ব্যাটে দুইশ ছাড়ায় সফরকারীরা।
একের পর এক ক্যাচের ছেড়ে দেওয়ার পাশাপাশি গ্রাউন্ড ফিল্ডিংয়ের ব্যর্থতায় অস্ট্রেলিয়ার ঘুরে দাঁড়ানোর কাজটি সহজ করেন বাংলাদেশের ফিল্ডাররা। অন্তত ৩টি ক্যাচ পড়ে তাদের হাত থেকে। সীমানায় হাতের ফাঁক গলে বাউন্ডারি হয় বেশ কয়েকটি।
সফরকারীদের জয়ে বড় অবদান রাখা ৯ নম্বরে নেমে খেলেন ৩১ বলে ৪৬ রানের ঝড়ো ইনিংস খেলেন কিং। পরে বল হাতে ১০ ওভারে ৩ মেইডেনসহ স্রেফ ১২ রানে ১ উইকেট নেন এই লেগ স্পিনার। চাপের মুখে ৭৬ বলে ৫৮ রানের অপরাজিত ইনিংস খেলেন সাদারল্যান্ড।
দুজন মিলে অষ্টম উইকেটে স্রেফ ৫৬ বলে যোগ করেন ৬৭ রান। শেষ ওভারে ফাহিমা খাতুনের বলে ৪ ছক্কা ও ১ চার মারেন কিং। সব মিলিয়ে ওভার থেকে আসে ২৯ রান। নারী ওয়ানডের ইতিহাসে এটিই এক ওভারে সবচেয়ে বেশি রান খরচের রেকর্ড। ২০১৮ সালে ভারতের বিপক্ষে দক্ষিণ আফ্রিকার পেসার আয়াবঙ্গা খাকা দিয়েছিলেন ওভারে ২৮ রান।
অ্যানাবেল সাদারল্যান্ড ও অ্যালানা কিংয়ের জুটি বদলে দেয় ম্যাচের মোড়।
|
ছবি: বিসিবি।
দলীয় ফল আশানুরূপ না হলেও দারুণ বোলিংয়ে বড় অর্জন ধরা দিয়েছে নাহিদা আক্তারের। ২৭ রানে ২ উইকেট নিয়ে সালমা খাতুনকে টপকে তিনিই এখন ওয়ানডেতে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি। ৩৯ ইনিংসে নাহিদার ঝুলিতে উইকেট ৫৩টি। ৪৪ ইনিংসে ৫১ উইকেট নিয়ে এত দিন শীর্ষে ছিলেন ২০২২ সালে সবশেষ ওয়ানডে খেলা সালমা।
বৃষ্টিভেজা কন্ডিশনে অস্ট্রেলিয়াকে আগে ব্যাটিংয়ে পাঠায় বাংলাদেশ। প্রথম ওভারের শেষ বলে হিলির ফিরতি ক্যাচ ছাড়েন মারুফা। তবে দ্বিতীয় ওভারের প্রথম বলেই দারুণ টার্ন করা ডেলিভারিতে ফিবি লিচফিল্ডকে ফেরান সুলতানা খাতুন।
পরে এলিস পেরিকেও থামান এই অফ স্পিনার। স্লিপে ক্যাচ দিয়ে ফেরেন অস্ট্রেলিয়ান অভিজ্ঞ অলরাউন্ডার।
হিলি জীবন পান ৮ রানেও। স্লিপে ক্যাচ নিতে পারেননি ফাহিমা। তবে সুযোগ পুরো কাজে লাগাতে পারেননি অস্ট্রেলিয়ান অধিনায়ক। মারুফার বলে আউট হন তিনি ২৪ রানে।
ত্রিশের আগে ৩ উইকেট হারিয়ে চাপে পড়ে যায় অস্ট্রেলিয়া। পঞ্চাশ হওয়ার আগেই ১৯তম ওভারে তাহলিয়া ম্যাকগ্রাকে এলবিডব্লিউ করেন নাহিদা। চার নম্বরে নামা বেথ মুনি লম্বা সময় উইকেটে থেকে ৬৪ বলে করেন ২৫ রান। তার বিদায়ে ৭৮ রানে পড়ে পঞ্চম উইকেট।
এরপর প্রাথমিক প্রতিরোধ গড়েন গার্ডনার ও সাদারল্যান্ড। ১৬ রানের মাথায় লং অনে গার্ডনারের সহজ ক্যাচ ছাড়েন সোবহানা মোস্তারি। জীবন পেয়ে আরও ১৬ রান করেন ২৬ বছর বয়সী অলরাউন্ডার। তাকে ফিরিয়ে তখন পর্যন্ত ইনিংসের সর্বোচ্চ ৩৪ রানের জুটি ভাঙার পাশাপাশি সালমাকে টপকে যান নাহিদা।
সপ্তম উইকেটে ৩৪ রান যোগ করেন সাদারল্যান্ড ও জর্জিয়া ওয়্যারহ্যাম। যদিও রানের গতি তখনও তেমন বাড়েনি। চল্লিশ ওভারেও দেড়শ ছুঁতে পারেনি সফরকারীরা। স্বর্ণা আক্তারের বলে স্লিপে রাবেয়ার অসাধারণ ক্যাচে ওয়্যারহ্যামের বিদায়ের পরই বদলে যায় দৃশ্যপট।
ইতিবাচক ব্যাটিংয়ে দ্রুত রান তুলতে থাকেন সাদারল্যান্ড ও কিং। ক্যারিয়ারের তৃতীয় পঞ্চাশ ছোঁয়া ইনিংসটি ৫ চারে সাজান সাদারল্যান্ড। ২ চারের সঙ্গে ৫টি ছক্কা মারেন কিং। অস্ট্রেলিয়ার হয়ে এটিই ইনিংসে সর্বোচ্চ ছক্কার রেকর্ড।
শেষ ওভারে ২৯ রান দেওয়া ফাহিমা সব মিলিয়ে ৯ ওভারে খরচ করেন ৬৭ রান। বাংলাদেশের হয়ে ওয়ানডেতে এটিই সবচেয়ে বেশি রান খরচের রেকর্ড। এর আগে ভিন্ন ভিন্ন ম্যাচে ৬২ রান করে দেন রুমানা আহমেদ, জাহানারা আলম ও নাহিদা আক্তার।
রান তাড়ায় বাংলাদেশ বড় ধাক্কা খায় শুরুতেই। প্রথম ওভারেই ড্রেসিং রুমে ফেরেন অভিজ্ঞ ব্যাটার ফারজানা হক। তিন নম্বরে নামা মুর্শিদা খাতুনও ফেরেন অল্পেই।
জোড়া ধাক্কা সামলে দলে টেনে তোলার চেষ্টা করেন নিগার ও সোবহানা। বাংলাদেশের সম্ভাবনা একটু হলেও টিকে ছিল তখন। কিন্তু ৪৯ রানের জুটি ভাঙার পর ভেঙে পড়ে বাংলাদেশ।
কিংয়ের লেগ স্পিনে পায়ের পেছন দিয়ে বোল্ড হন ৩৮ বলে ১৭ রান করা সোবহানা। এরপর একের পর এক ব্যাটসমানের আসা-যাওয়া চলতেই থাকে।
পরপর তিন ব্যাটার বিদায় নেন রান আউটে। ফিবি লিচফিল্ডের দারুণ ফিল্ডিংয়ের পর সরাসরি থ্রোয়ে বিদায়ঘণ্টা বাজে ফাহিমার। রিতু মনিকে সরাসরি থ্রোয়ে রান আউট করেন বেথ মুনি। ক্রিজ পার করলেও ব্যাট বাতাসে থাকায় বিদায়ঘণ্টা বাজে রিতুর।
এরপর নিগারের সেই আলসে রান আউট। দলের সর্বোচ্চ ২৭ রান করেন বাংলাদেশ অধিনায়ক। পরের ব্যাটাররা আর তেমন কিছু করতে পারেননি।
দিনটি ছিল বাংলাদেশের জন্য হতাশার।
|
ছবি: বিসিবি।
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
অস্ট্রেলিয়া: ৫০ ওভারে ২১৩/৭ (হিলি ২৪, লিচফিল্ড ০, পেরি ২, মুনি ২৫, ম্যাকগ্রা ৯, গার্ডনার ৩২, সাদারল্যান্ড ৫৮*, ওয়্যারহ্যাম ১২, কিং ৪৬*; মারুফা ৭-০-২২-১, সুলতানা ১০-০-৪২-২, নাহিদা ১০-১-২৭-২, রাবেয়া ১০-১-৩৩-০, ফাহিমা ৯-০-৬৭-১, স্বর্ণা ৪-০-১৯-১)
বাংলাদেশ: ৩৬ ওভারে ৯৫ (ফারজানা ০, সোবহানা ১৭, মুর্শিদা ১০, নিগার ২৭, ফাহিমা ১, রিতু ১, স্বর্ণা ৬, রাবেয়া ৫, নাহিদা ৩*, সুলতানা ২, মারুফা ০; শুট ৬-১-৫-১, গার্থ ৭-১-২৬-২, গার্ডনার ৫-১-২২-৩, ওয়্যারহ্যাম ৪-০-১৭-০, কিং ১০-৩-১২-১, পেরি ৪-১-৫-০)
ফল: অস্ট্রেলিয়া ১১৮ রানে জয়ী
প্লেয়ার অব দা ম্যাচ: অ্যালানা কিং।