শুক্র. এপ্রিল 19th, 2024

অরিত্রীকে পৃথিবী ছাড়তে বাধ্য করেছে শিক্ষকরা: আদালতে বাবা

ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ছাত্রী অরিত্রী অধিকারীর আত্মহত্যায় প্ররোচনার মামলায় সাক্ষ্য দিতে এসে কাঁদলেন তার বাবা দিলীপ অধিকারী।

আসামি হিসেবে অরিত্রী দুই শিক্ষককে শনাক্ত করে তিনি বললেন, “আমার সন্তানকে পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য করেছেন তার শিক্ষকরা।”

আলোচিত এ মামলার বিচার চলছে ঢাকার তৃতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ রবিউল আলমের আদালতে।

সোমবার সেখানে হাজির হয়ে সাক্ষ্য দেন অরিত্রীর বাবা, আইন অনুযায়ী আসামিদের শাস্তি চান বিচারকের কাছে।

তিনি বলেন, “অরিত্রী খুব ভালো ছাত্রী ছিল। তার তিন শিক্ষিকা তার প্রতি রূঢ় আচরণ করেছেন। ১৪ বছরের মেয়ের সামনে বাবা-মাকে অপমান করা হয়েছে। বাবা-মায়ের অপমান সহ্য করতে না পেরে অরিত্রী আত্মহত্যা করেছে।”

গত বছরের ৩ ডিসেম্বর শান্তিনগরের বাসায় গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করে নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী অরিত্রী (১৫)। তার আগের দিন পরীক্ষায় নকল করার অভিযোগে তাকে পরীক্ষা হল থেকে বের করে দিয়েছিল স্কুল কর্তৃপক্ষ।

স্কুল কর্তৃপক্ষের দাবি, অরিত্রী পরীক্ষায় মোবাইল ফোনে নকল নিয়ে টেবিলে রেখে লিখছিল। অন্যদিকে স্বজনদের দাবি, নকল করেনি অরিত্রী।

এরপর অরিত্রীর বাবা-মাকে ডেকে নেওয়া হয় স্কুলে। তখন অরিত্রীর সামনে তার বাবা-মাকে অপমান করা হয়েছিল বলে অভিযোগ ওঠে। ওই দিনই আত্মহত্যা করে অরিত্রী।

অরিত্রীর আত্মহত্যার পর তার সহপাঠিদের বিক্ষোভে নামে, ৪ ডিসেম্বর তার বাবা দিলীপ অধিকারী আত্মহননে প্ররোচনার অভিযোগ এনে মামলা করেন।

তদন্ত শেষে পুলিশ ভিকারুননিসার প্রধান ক্যাম্পাসের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক নাজনীন আক্তার ও প্রভাতি শাখার প্রধান জিনাত আরার বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দিলে গত ১০ জুলাই অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে তাদের বিচার শুরু করে আদালত।

সোমবার সাক্ষ্য দিতে দাঁড়িয়ে মামলার বাদী দিলীপ অধিকারী বলেন, “গত বছর ২ ডিসেম্বর ভুলবশত অরিত্রী বাসায় ব্যবহৃত একটি মোবাইল ফোন স্কুলে নিয়ে যায়। সেদিন তার সমাজ পরীক্ষা চলছিল। পরীক্ষার শেষে দিকে শ্রেণি শিক্ষিকা হাসনা হেনা তার মোবাইল ফোনটি নিয়ে নেন। পরদিন অরিত্রীকে অভিভাবক নিয়ে স্কুলে যেতে বলেন।

“অরিত্রী বাসায় এসে বিষয়টি আমাদের জানায়। পরদিন স্ত্রী বিউটি অধিকারীসহ আমি অরিত্রীর স্কুলে যাই। শ্রেণি শিক্ষিকা হাসনা হেনা আমাদের অধ্যক্ষের রুমের সামনে অভিভাববদের ওয়েটিং রুমে বসিয়ে রাখেন।

“পরে ১১টার দিকে শাখা প্রধান জিনাত আক্তারের রুমে নিয়ে যায়। আমাদের নিয়ে যাওয়ার পর তিনি রাগান্বিত হয়ে বলেন, আপনার মেয়েকে টিসি দিয়ে দেওয়া হবে।”

দিলীপ বলেন, তারা তখন শাখা প্রধানকে অরিত্রীর অপরাধ ক্ষমা করে দিতে অনুরোধ করেন। মেয়েটি যাতে পরীক্ষা দিতে পারে, সেই সুযোগ চান। কিন্তু জিনাত আক্তার টিসি দেওয়ার সিদ্ধান্তে অনড় থাকেন।

জবানবন্দি দিতে গিয়ে এরপর কেঁদে ফেলেন অরিত্রীর বাবা।

তিনি বলেন, “জিনাত আক্তারের কাছ থেকে পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ না পেয়ে সাবেক ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ নাজনীন ফেরদৌসের কাছে যাই। উনার রুমে গিয়েও মেয়ের জন্য ক্ষমা চাই এবং পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ চাই। আমার সামনেই তিনি অরিত্রীর সাথে বাজে ব্যবহার করেন।

“তিনি আমাদের রুম থেকে বের করে দেন। পরে আমরা আবারও তার রুমে যাই। তখন তিনি আমাদের বলেন, আবার কেন ঢুকছেন? কিছুক্ষণ পর দেখি অরিত্রী সেখানে নেই। স্কুলে খুঁজে না পেয়ে বাসায় চলে আসি। এসে দেখি অরিত্রী বাসায়।”

আদালতকে দিলীপ বলেন, সেদিন বেলা ১টার দিকে তিনি বাসা থেকে বের হয়ে যান। বিকেল ৩টার দিকে স্ত্রী তাকে ফোন করে বলেন, অরিত্রী দরজা খুলছে না। তার ঘর ভেতর থেকে আটকানো।

এরপর বাসার কেয়ার টেকারসহ সকলে দরজা খোলার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। তখন ভেন্টিলেটর দিয়ে কেয়ার টেকার রুমে ঢুকে দেখতে পায়, গলায় ওড়না প্যাঁচানো অরিত্রীর দেহ সিলিং ফ্যান থেকে ঝুলছে।

অচেতন অরিত্রীকে প্রথমে কাকরাইল ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক অরিত্রীকে মৃত ঘোষণা করেন।

শিক্ষকরা বাজে ব্যবহার করায় এবং তার সামনে বাবা-মাকে অপমান করায় সইতে না পেরে অরিত্রী আত্মহত্যা করেছে অভিযোগ করে আদালতের কাছে ন্যায়বিচার চান তার বাবা।

আসামিপক্ষের আইনজীবী সীমা আক্তার এরপর দিলীপ অধিকারীকে জেরা শুরু করেন।

এদিন জেরা শেষ না হওয়ায় আদালত আগামী ২ ফেব্রুয়ারি অবশিষ্ট জেরা এবং পরবর্তী সাক্ষীদের সাক্ষ্যগ্রহণের দিন ধার্য করেন বলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান বাদীর ব্যাক্তগত আইনজীবী সবুজ বাড়ৈ।

দুই আসামি নাজনীন ফেরদৌস ও জিনাত আক্তার এদিন আদালতে উপস্থিত ছিলেন।

অরিত্রীর বাবার করা মামলায় শ্রেণি শিক্ষক হাসনা হেনাকেও আসামি করা হয়েছিল।  তবে তদন্তে তার সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ না পাওয়ায় অভিযোগ থেকে তাকে অব্যাহতি দেয় আদালত।

অরিত্রী অপ্রাপ্তবয়স্ক হওয়ায় দণ্ডবিধির ৩০৫ ধারায় এ মামলার অভিযোগপত্র দেন তদন্ত কর্মকর্তা। এই ধারায় কোনো শিশুকে আত্মহত্যার প্ররোচনা দেওয়ার অভিযোগ প্রমাণিত হলে ১০ বছর কারাদণ্ড থেকে মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত সাজার বিধান রয়েছে।

আদালত প্রতিবেদক,  বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম