বৃহস্পতি. এপ্রিল 25th, 2024

কুড়িগ্রামে নির্মাণের দু’মাসেই সেতুতে ভাঙন

নিউজ ডেস্ক:

কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলার রমনা ইউনিয়নের চর পাত্রখাতা সাব-বাঁধ এলাকার একটি সেতু নির্মাণের দুমাস না পেরুতেই বানের পানির তোড়ে ভেঙে গেছে। এতে কুড়িগ্রাম ছাড়াও গাইবান্ধার সতেরটি গ্রামের মানুষ অনেকটাই যোগাযোগ বিছিন্ন হয়ে পড়েছেন। সেতু ভেঙে পড়ায় স্থানীয়রা নিজেদের উদ্যোগে একটি সাঁকো তৈরি করে কোনোরকমে চলাচল করছেন।

তবে নড়বড়ে সাঁকো দিয়ে পারাপারে প্রায়ই দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন অনেকে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার পর শিক্ষার্থীরাও প্রতিদিন ঝুঁকি নিয়ে সাঁকো পার হচ্ছেন। স্থানীয় বাসিন্দা হাবিবুর রহমান জানান, গত ৭-৮ দিন আগে এ সাঁকো দিয়ে পারাপারের সময় হঠাৎ নিচে পড়ে যাই। নিচে থাকা ইটে মাথায় প্রচণ্ড আঘাত পাই। মাথা ফেটে যায়। পরে হাসপাতালে গেলে চিকিৎসক ক্ষত স্থানে সেলাই করে দেন। সেতু সংলগ্ন বসতবাড়ির বাসিন্দা হাফিজুর রহমান জানান, এ এলাকায় আমাদের সব সময় নানা দুর্যোগের সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকতে হয়। বাড়ির পাশের ওই ভাঙা সেতু পার হতে গিয়ে আমার ছোট্ট ভাতিজি পানিতে পড়ে মারা গেছে। কিছুদিন আগে স্থানীয় এক ব্যাক্তি দোকান ঘর নির্মাণের জন্য ইট নিয়ে এ সাঁকো পার হওয়ার সময় নিচে পড়ে গেলে মাথা ফেটে যায়। সেতু এলাকার আরেক বাসিন্দা আবদুল কুদ্দুস জানিয়েছেন, এলাকার রজ দেওয়ানী নামের এক ব্যক্তি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে হাসপাতালে নেওয়ার পথে ঝুঁকিপূর্ণ এ সাঁকো পার হওয়ার সময় স্ট্রোক করে তিনি মারা যান। স্থানীয় বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম অভিযোগ করে বলেন, এখানে যে সাঁকোটি দুলছে, আমরা স্থানীয়রা তিন বছর আগে এটি তৈরি করে প্রতি বছর সংস্কার করে চলাচল করছি। এটি তৈরিতে উপজেলা প্রশাসন কিংবা সরকারি কোনো অর্থ সহযোগিতাও পাইনি। সহায়তার জন্য লিখিত আবেদনসহ একাধিকবার মৌখিকভাবে জানিয়েও কোনো কাজ হয়নি। তিনি বলেন, মাস তিনেক আগে স্থানীয় বাসিন্দা এরশাদুলের ছেলে আবদুল কুদ্দুস সাঁকোটি পার হওয়ার সময় পড়ে গিয়ে জখম হন। কদিন আগেই স্থানীয় বাসিন্দা আইয়ুব আলীর ছেলে হাবিবুর রহমান ইট নিয়ে সাঁকো পার হতে গিয়ে গুরুতর আহত হন। সাঁকো পারাপারে শিশুরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকে।

সম্প্রতি গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার হরিপুর ইউনিয়নের বৃদ্ধ হজরত ব্যাপারী সাঁকোটি পারাপারের সময় নিচে পড়ে গুরুতর জখম হন। পরে তিনি চিকিৎসা বাবদ ১০-১৫ হাজার টাকা খরচ করেন।

রফিকুল ইসলামের অভিযোগ, এখানে তো যাচ্ছেতাইভাবে একটা সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। দুমাস পেরুনোর আগেই সেই সেতু ভেঙে গেছে। আমাদের তো সেতুর দরকার নেই, এখানে আমাদের রাস্তা দরকার। রাস্তা হলে এলাকাবাসী নদীভাঙনের হাত থেকেও রক্ষা পাবে। বাঁচবে ফসলি জমি। সবাই নিরাপদে চলাচল করতে পারবে। শিগগিরই রাস্তা নির্মাণের পদক্ষেপ না নিলে এখানকার বেশ কিছু বসতবাড়ি ভাঙনে বিলীন হতে পারে। চরপাত্রখাতা এলাকার গৃহবধূ জোসনা বেগম জানান, সেতুটি ভেঙে যাওয়ায় ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করতে হচ্ছে। সাঁকো দিয়ে চলাচলের সময় পা পিছলে যায়। রাতে চলাচল করতে খুবই কষ্ট হয়। এদিকে সেতুটি ভেঙে পড়ায় সাঁকো দিয়ে পারাপারে ওই এলাকার কমিউনিটি ক্লিনিকে যেতে দুর্ভোগে পড়ছেন স্থানীয়রা। এছাড়াও ইউনিয়নের ডাংরার চর সাব-বাঁধ প্রাথমিক বিদ্যালয়, পাত্রখাতা রিয়াজুল জান্নাহ দাখিল মাদ্রাসা, পাত্রখাতা তালিমুল কোরআন নূরানী মাদ্রাসা, চর পাত্রখাতা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ পূর্ব পাত্রখাতা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকা ও ছাত্রছাত্রীদের সাঁকোটি দিয়ে পারাপারের সময় নানা রকম ভোগান্তিসহ দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। পাত্রখাতা রিয়াজুল জান্নাহ দাখিল মাদ্রাসার সিনিয়র সহকারী মৌলভী মো. রফিকুল ইসলাম জানান, এলাকার মানুষের যোগাযোগের সবচেয়ে বড় মাধ্যম এ সেতু। দ্রুত সেতুটির সংস্কার না হলে ভোগান্তি আরও অসহনীয় হয়ে উঠবে। আগে কৃষকেরা মাঠের ধান ঘোড়ার গাড়িতে করে বাড়ি নিয়ে আসতো, সেতু ভেঙে পড়ার পর কৃষকেরাও পড়েছেন বিপাকে। কেউ অসুস্থ হলে দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া যায় না, সেতুটি ভাঙা থাকার কারণে। বেহাল সেতুর কারণে এলাকাবাসী যেমন ভোগান্তি পোহাচ্ছেন, আবার নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দামেও তাদের হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। শহর থেকে পণ্য আনতে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের পরিবহন খরচ বাড়ায় পণ্যের দামও বেড়েছে। যার মাশুল গুণতে হবে সাধারণ মানুষকে। অথচ সেতুটি সচল থাকলে সবকিছুই আরও সহজ ও সুলভ হতো বলে মনে করেন এলাকাবাসী।

স্থানীয় ব্যবসায়ী আইয়ুব আলী জানান, তিনি জেলার চিলমারী উপজেলার শেষ প্রান্তে থাকেন। সাঁকোটি এলাকাবাসী নিজ খরচে তৈরি করেছে। কিন্তু সাঁকোর উপর দিয়ে যানবাহন চলাচল করতে না পারায় উৎপাদিত ফসল ঘরে তুলতে কৃষকের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। পরিবহন ব্যবস্থা ভালো না থাকায় উৎপাদিত ফসল বাজারজাতও করতে পারছেন না অনেকে। তিনি বলেন, আমি একজন স্টক ব্যবসায়ী। প্রতি বছর ধান, গম, সরিষাসহ বিভিন্ন ফসল কৃষকদের কাছ থেকে কিনে মজুদ করতাম। বাইরের ক্রেতারা এসে সেসব কৃষিপণ্য লাভজনক দামে কিনে নিতো। সেতুটি ভেঙে যাওয়ায় ক্রেতারা আসছেন না। বাধ্য হয়ে ব্যবসা বন্ধ করতে হচ্ছে। জানা গেছে, উপজেলার রমনা ইউনিয়নের পাত্রখাতা ব্যাপারী পাড়া সাব-বাঁধ এলাকায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের সেতু/কালভার্ট নির্মাণ প্রকল্পের অধীনে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৩০ লাখ ৯০ হাজার টাকা ব্যয়ে ৪০ ফিট সেতুটি নির্মাণ করা হয়। নির্মাণের দুই মাস না যেতেই বন্যার পানিতে ভেঙে যায় সেতুসহ সংযোগ সড়কের আনুমানিক চল্লিশ ফিট পর্যন্ত। পরে এলাকাবাসী স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানের সামান্য আর্থিক সহযোগিতায় সেতু লাগোয়া কাঠ ও বাঁশ দিয়ে এক সাঁকো তৈরি করেন। এই সাঁকো দিয়েই ঝুঁকি নিয়ে চলে প্রতিদিনের পারাপার। ঘটে দুর্ঘটনাও। এ ব্যাপারে রমনা মডেল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আজগার আলী সরকার বলেন, কুড়িগ্রাম জেলার মধ্যে চিলমারী উপজেলা একটি বন্যাপ্রবণ এলাকা। গত ২০১৬-১৭ অর্থবছরে পাত্রখাতা সাব-বাঁধ এলাকায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের অধীনে একটি সেতু নির্মাণ হয়। পরে বন্যায় সেতুটি ভেঙে গেলে স্থানীয়রা একটি সাঁকো তৈরি করে যাতায়াত শুরু করে। সেখানে সেতুর পরিবর্তে মাটি ভরাট করে রাস্তা নির্মাণের জন্য আবেদন জানিয়েছি। বিষয়টি উপজেলার মাসিক মিটিংয়ে উপস্থাপন করেছি।
ভেঙে পড়ে থাকা সেতুটি নিয়ে কী পরিকল্পনা, সে বিষয়ে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) মো. কোহিনুর রহমান জানান, জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা) থেকে একটি প্রকল্প দেবে। সে প্রস্তাবটি আমরা পাঠাবো। প্রস্তাবটিতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) স্যারের স্বাক্ষরের অপেক্ষায় রয়েছি। দু-একদিনের মধ্যে প্রস্তাবটি মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দিতে পারবো। সেতুর পরিবর্তে স্থানীয়দের রাস্তা নির্মাণের দাবি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, স্থানীয়দের চাওয়ার বিষয়টিও আমাদের মাথায় রয়েছে। প্রকল্পটি পেলে সেখানে একটি রাস্তা এবং পানি নিষ্কাশনের জন্য একটি সেতুও নির্মাণ করা হবে।