শুক্র. এপ্রিল 19th, 2024

১৩ জন শনাক্ত, গ্রেফতার হয়নি মূল আসামিরা

বরগুনায় স্ত্রীর সামনে প্রকাশ্যে স্বামী রিফাত শরীফকে কুপিয়ে হত্যার ঘটনার তিন দিন অতিবাহিত হলেও মূল অভিযুক্তদের গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন, হত্যাকাণ্ডে জড়িত ১৩ জন শনাক্ত হয়েছে। তাদের দেশত্যাগ ঠেকাতে সর্বোচ্চ সতর্কতা জারি করা হয়েছে। বরগুনার পুলিশ সুপার বলেছেন—মাদক নয়, ব্যক্তিগত কারণেই এ হত্যাকাণ্ড ঘটেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। মূল হোতাদের ধরতে র্যাব ও পুলিশের একাধিক টিম মাঠে কাজ করছে। শিগগিরই দেশবাসীকে কাঙ্ক্ষিত খবরটি দিতে পারবেন তাঁরা। এদিকে, নিহত রিফাতের স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নির নিরাপত্তায় তাঁর বাড়িতে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। এ ঘটনায় নয়ন বন্ডসহ ১২ জনকে আসামি করে হত্যা মামলা হয়েছে।

গত বুধবার সকালে বরগুনা সরকারি কলেজের সামনের সড়কে স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নির সামনেই স্বামী রিফাত শরীফকে দেশীয় অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে মারাত্মক আহত করেন নয়ন বন্ড, রিফাত ফরাজীসহ তাদের সহযোগীরা। মিন্নি অনেক চেষ্টা করেও স্বামীকে রক্ষা করতে পারেননি। পরে রিফাতকে উদ্ধার করে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিত্সাধীন অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয়। এ হত্যাকাণ্ডের ছবি ও ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হলে গণমাধ্যমগুলোতেও উঠে আসে এ খবর। রিফাত হত্যায় জড়িতদের দ্রুত গ্রেফতার করে বিচারের আওতায় আনার নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এছাড়া, বৃহস্পতিবার উচ্চ আদালত এ ঘটনায় বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, ‘এতগুলো মানুষ দেখলেন, কেউ প্রতিবাদ করলেন না, সমাজ কোন দিকে যাচ্ছে?’

১৩ জন শনাক্ত :স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল জানিয়েছেন, রিফাত হত্যার ঘটনায় জড়িত ১৩ জনকে শনাক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তিনি বলেন, এ ঘটনায় জড়িতরা যে দলেরই হোক, কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। বাকিরা অচিরেই ধরা পড়বে। গতকাল শুক্রবার পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোডে পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারের ঐতিহাসিক ভবন সংরক্ষণ প্রকল্পের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা বলেন। মন্ত্রী বলেন, আমাদের প্রধানমন্ত্রী সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে যাচ্ছেন। তাই, আপনারা যারা সন্দেহ করছেন আমাদের দলের কেউ জড়িত থাকলে ছাড় পাবে, আপনাদের সেই ধারণা ভুল।

দেশত্যাগ ঠেকাতে সতর্কতা :রিফাতের ঘাতকরা যাতে দেশ ছেড়ে পালাতে না পারে, সেজন্য আগের দিনই সীমান্তে সতর্কতা জারির নির্দেশ দিয়েছিল হাইকোর্ট। পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) সোহেল রানা গতকাল সেই নির্দেশনা জারির কথা জানান। পুলিশের এ কর্মকর্তা বলেন, বরগুনা জেলা পুলিশের পাশাপাশি পিবিআই, সিআইডি, র্যাব এবং ডিএমপির কাউন্টার টেররিজম ইউনিট আসামিদের গ্রেফতারের লক্ষ্যে কাজ করছে।

এদিকে, পুলিশ সদর দফতরের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, আসামিরা যেন দেশত্যাগ করতে না পারে, সে জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট সব বিমানবন্দর, স্থলবন্দর ও নৌবন্দরকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আসামিদের শিগগিরই আইনের আওতায় আনা সম্ভব হবে। আসামিদের বিষয়ে কারো কাছে কোনো তথ্য থাকলে তা পুলিশকে জানাতে অনুরোধ করা হয়েছে।

রিফাত হত্যা ব্যক্তিগত কারণে :রিফাত হত্যার পেছনে ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব্ব কাজ করেছে বলে ধারণা করছে বরগুনার পুলিশ। গতকাল দুপুরে জেলা পুলিশ সুপার মারুফ হোসেন এক সংবাদ সম্মেলনে এ দাবি করেন। এ সময় তিনি আরো জানান, এ ঘটনায় দুজন আসামি এবং একজন সন্দেহভাজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘মাদকের কারণে নয়, বরং ব্যক্তিগত কারণে এ হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। এর বেশি কিছু তদন্তের স্বার্থে বলা যাচ্ছে না।’ পুলিশ সুপার আরো বলেন, ‘এ হত্যাকাণ্ডের মূল নায়ক নয়ন বন্ডের নামে মাদক, হামলা, ছিনতাই এবং চুরির আটটি মামলা রয়েছে। এছাড়া রিফাত ফরাজীর নামেও চারটি মামলা রয়েছে বরগুনা থানায়।’ আসামি গ্রেফতারের ক্ষেত্রে কোনো রাজনৈতিক চাপ আছে কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে মারুফ হোসেন বলেন, ‘এমন কোনো চাপের বিষয়ই নেই। পুলিশ পুরোপুরি স্বাধীনভাবে হত্যাকারীদের গ্রেফতারে বিভিন্ন স্তরে ফাঁদ পেতে রেখেছে। দ্রুততম সময়ের মধ্যেই আসামিদের ধরা পড়তেই হবে।’

এদিকে পুলিশের বরিশাল বিভাগের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) মো. শফিকুল ইসলাম বলেছেন, পুলিশ যে কোনো মূল্যে হত্যাকারীদের ধরবে। পুলিশ সদস্যদের মধ্যে কারো এ ব্যাপারে কোনো গাফিলতি থাকলে তার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে হুঁশিয়ারি দেন পুলিশের এ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা।

গ্রেফতার হয়নি নয়ন বন্ড ও রিফাত ফরাজী :এ হত্যার ঘটনায় রিফাতের বাবা দুলাল শরিফ বৃহস্পতিবার সকালে ১২ জনকে আসামি করে বরগুনা সদর থানায় মামলা করেছেন। এজাহারভুক্ত দুই আসামিসহ তিনজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। বরগুনা থানার ওসি আবীর মোহাম্মদ হোসেন জানান, মামলার এজাহারভুক্ত আসামি চন্দন ও হাসান এবং এজাহারের বাইরে নাজমুল নামে আরো একজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। কিন্তু ঘটনার মূল আসামি নয়ন বন্ড ও রিফাত ফরাজীকে গতকাল রাত ৮টা পর্যন্ত গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। এছাড়া ঘটনার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে বরিশাল লঞ্চঘাট থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাওয়া এমভি মানামী লঞ্চ থেকে চারজনকে আটক করা হয়। তবে হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার প্রমাণ না পাওয়ায় তাদের ছেড়ে দিয়েছে পুলিশ ।

মিন্নিকে জিম্মি করে কাগজে সই নিয়েছিল নয়ন! :রিফাতের স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি সহযোগী একটি সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, নয়ন আমাকে খুব উত্ত্যক্ত করত। আমাকে হুমকি দিত এবং অস্ত্র দেখিয়ে ভয় দেখাত। নয়ন আমার স্কুলপড়ুয়া ভাই এবং বোনকেও মেরে ফেলার হুমকি দেয়। আমার বাবাকেও বিভিন্ন সময়ে হুমকি দিত। একদিন অস্ত্রের মুখে আমাকে জিম্মি করে একটি বাসায় নিয়ে যায় নয়ন। পরে সেখানে বসে একটি কাগজে আমার স্বাক্ষর নেয় সে। তবে সেই স্বাক্ষর দিয়ে নয়ন কিছু করেছে কি না আমি জানি না। তিনি আরো বলেন, যারা আমার নামে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নোংরা মন্তব্য করেছে, আমি তাদের শাস্তি চাই।

মিন্নি আরো বলেন, আমার বিয়ে হয়েছে একমাত্র রিফাত শরীফের সঙ্গে। এছাড়া আমার আর কখনো কারো সঙ্গে বিয়ে হয়নি। আমি এ ঘটনার সুষ্ঠু বিচার চাই। প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমার একটাই দাবি, যারা আমার স্বামীকে হত্যা করেছে আমি তাদের ফাঁসি চাই। এদিকে আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নির নিরাপত্তায় পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। শহরের মাইঠা এলাকায় মিন্নির বাড়িতে গতকাল দুপুর থেকে পুলিশ মোতায়েন করা হয়। বরগুনার পুলিশ সুপার মো. মারুফ হোসেন এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের সংবাদ সম্মেলন :গতকাল বিকালে বরগুনা জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও সাবেক এমপি মো. দেলোয়ার হোসেন জেলা প্রেসক্লাবে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘খুনিরা কেউই আমার রক্তের সম্পর্কিত আত্মীয় নয়। তবে বৈবাহিক সূত্রে আত্মীয়।’ তিনি আরো বলেন, ‘এই সন্ত্রাসীদের নানা অপকর্মের খবর জানতে পেরে কয়েকবার তাদের পুলিশের হাতে সোপর্দ করেছি। কিন্তু আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে এসে তারা আবারও অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছিল। আমি এ নৃশংস হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের ফাঁসির দাবি করছি। বিভিন্ন মিডিয়া আমাকে নিয়ে যে অপপ্রচার চালাচ্ছে তা থেকে বিরত থাকার জন্য সাংবাদিকদের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।’

তিন আসামি রিমান্ডে

রিফাত হত্যা মামলায় গ্রেফতারকৃত আসামি চন্দন ও হাসানের সাত দিন ও আরেক আসামি নাজমুল হাসানের তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। গতকাল বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে বরগুনার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক মোহাম্মদ রাসেল এ রিমান্ড আদেশ দেন। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বরগুনা সদর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) হুমায়ন কবির এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।