সোম. এপ্রিল 29th, 2024

রংপুরে তিস্তা নদীর পানি বিপৎসীমার নীচে বিপদ কাটেনি

নিতাই রায়, রংপুর :

তিস্তা নদীর পানি কমে বিপৎসীমার নীচ দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় রংপুরে তিস্তা পাড়ের নিম্নাঞ্চল থেকে নামতে শুরু করেছে পানি। আজ বৃহস্পতিবার  সকালে তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ৬৮ সেন্টিমিটার নীচ ও কাউনিয়া পয়েন্টে ২৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে রংপুরে বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি ঘটেছে।বুধবার সকালে থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পানি বাড়লেও রাত দশটার পর থেকে তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্টে পানি কমতে শুরু করেছে। ফলে তিস্তা অববাহিকার চরাঞ্চলের মানুষজন মধ্যে বন্যার আতঙ্ক কমেছে।



 তিস্তা সেচ ব্যারাজের ৪৪টি জল কপাট  খুলে রাখা হয়েছে। রংপুর, লালমনিরহাট, নীলফামারী, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধা জেলার তিস্তা তীরবর্তী এলাকায় বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। ভারতের উজান থেকে ধেয়ে আসা ঢলে বাংলাদেশের তিস্তা বেষ্টিত উত্তরাঞ্চলেও বন্যার শঙ্কা করা হচ্ছে। সিকিম পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে সতর্কতা জারি করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। একইসঙ্গে নদী তীরবর্তী বাসিন্দাদের নিরাপদ স্থানে সরে নিতে কাজ করছে স্থানীয় প্রশাসন।

বৃহস্পতিবার (৫ অক্টোবর) সকাল ৯টায় দেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্টে তিস্তার পানিপ্রবাহ রেকর্ড করা হয়েছে ৫১ দশমিক ৪৭ সেন্টিমিটার, যা বিপৎসীমার ৬৮ সেন্টিমিটার নীচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে (স্বাভাবিক ৫২ দশমিক ১৫ সেন্টিমিটার)। অন্যদিকে সকাল ৯ টার তথ্যনুযায়ী রংপুরের কাউনিয়া পয়েন্টে পানি সমতলে বিপৎসীমার ২৫ সেন্টিমিটার (স্বাভাবিক ২৮ মিটার ৭৫ সেন্টিমিটার) ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। গতকাল বুধবার সকাল থেকে পানি বাড়তে শুরু করলে সন্ধ্যা ৬টায় তিস্তার পানি ডালিয়া ব্যারেজ পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ২০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। রাত ৭টা ও ৮টায় পানি বেড়ে ২৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে ও রাত ৯টায় পানি কমে বিপৎসীমার ০৫ সেন্টিমিটার নীচ দিয়ে প্রবাহিত হয়। এরপর রাত ১০টা থেকে তিস্তার পানি প্রবাহ আরও কমতে শুরু করেছে। তবে পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, ডালিয়া পয়েন্টের পানি সমতল আগামী ৬ ঘণ্টা পর্যন্ত হ্রাস পেয়ে পরবর্তীতে পুনরায় বৃদ্ধি পেতে পারে।



স্থানীয়রা জানান, তিস্তার পানি প্রবাহ বিপৎসীমার নিচে নেমে আসায় বন্যা পরিস্থিতিরও কিছুটা উন্নতি ঘটেছে। কমতে শুরু করেছে নিম্নাঞ্চলের পানি। এতে তারা শঙ্কা মুক্ত হতে শুরু করেছেন। তবে বন্যার পানিতে চরের কোথাও কোথাও শত শত হেক্টর জমির ধান ও শীতকালীন সবজি ক্ষেত তলিয়ে গেছে। পানি প্রবাহ কমে যাওয়ায় কোথাও কোথাও দেখা দিয়েছে নদী ভাঙন। তবে পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং আবহাওয়া অধিদপ্তরের সতর্কীকরণ বার্তায় আরো কয়েকদিন বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা এবং ভারত থেকে আসা পানিতে যেকোনো সময় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে বলেও আশঙ্কা রয়েছে।

এদিকে তিস্তা তীরবর্তী রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার লক্ষ্মীটারী ইউনিয়নের কেল্লার পাড়ে আনা হয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের উদ্ধারকারী মিনি জাহাজ। বুধবার সন্ধ্যার পর থেকে আতঙ্কিত তিস্তার দু পাড়ের মানুষদের অনেকেই গবাদিপশু, ধান-চালসহ ঘরবাড়ির গুরুত্বপূর্ণ মালামাল সরিয়ে নিয়েছেন। সব থেকে বিপাকে পড়েন আগাম লাগানো পাকাধান নিয়ে। এখন পানি কমতে শুরু করায় তাদের মনে কিছুটা স্বস্তি ফিরছে। অনেকেই ধান কেটে ঘরে তোলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।  


উপজেলা সদর বালাপাড়া ইউপি চেয়ারম্যান আনছার আলী বলেন, উজানের ঢলে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় আমার ইউনিয়ন সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যেহেতু ভয়াবহ বন্যার পূর্বাভাস পাওয়া গেছে, তাই আমার ইউনিয়নের মানুষদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া জন্য সকল প্রস্তুতি আগে থেকেই প্রস্তুত ছিলো। এখন পানি বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হলেও বৃষ্টি অব্যাহত থাকায় ভয় কাটেনি। আমাদের আশ্রয়কেন্দ্রগুলোও প্রস্তুত রয়েছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় নৌকা মজুত রাখা হয়েছে।বন্যায় মাঠি মিশ্রিত পানি আসার কারণে ধান মরিচসহ নানা ফসলের পলিমাঠি পরে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।

কাউনিয়া  উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোঃ মহিদুল হক  বলেন, আমাদের কাছে তথ্য আছে, এই বন্যাটি ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। এজন্য আমরা জনগণকে সতর্ক করছি। তাদের ধান-চাল, হাঁস-মুরগি, গবাদিপশুসহ প্রয়োজনীয় মালামাল বিভিন্ন স্কুল-কলেজ এবং আশ্রয়কেন্দ্র ছাড়াও উঁচু জায়গাতে নিয়ে যাওয়ার জন্য বলেছি। উঁচু স্কুলগুলোতে আমরা এরই মধ্যে থাকার জন্য ব্যবস্থা করে রেখেছি। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে আমাদের তৎপরতা আরও বাড়বে। ইতোমধ্যে আমরা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের তিস্তা-২ মিনি জাহাজ কেল্লার পাড়ে নিয়ে এসে রেখেছি। তবে রাত থেকে পানি বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হওয়াতে কিছুটা শঙ্কা কেটেছে। তারপরও আমরা সতর্ক অবস্থায় রয়েছি।এছাড়া উপজেলা প্রশাসনের কন্ট্রোল রুম চালু করা হয়েছে।



রংপুর পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্রে জানা যায়, উত্তর সিকিমে তিস্তা নদীর চুংথাং বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় বুধবার (৪ অক্টোবর) সকাল থেকে বাংলাদেশপ্রান্তে নদীর পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর আগে মঙ্গলবার মধ্যরাত থেকে গজলডোবা পয়েন্টে তিস্তা নদীর পানি ২৮৫ সেন্টিমিটার এবং দোমুহুনী পয়েন্টে বুধবার সকাল থেকে ৮২ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়েছে। তিস্তার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে অন্য নদীর পানিও। এতে রংপুর, লালমনিরহাট, নীলফামারী, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধা জেলার তিস্তা নদীর তীরবর্তী এলাকাগুলো প্লাবিত হয়ে বন্যার সম্ভাবনা রয়েছে। এ জন্য তিস্তা ব্যারাজের ৪৪টি জলকপাট খুলে রেখে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হচ্ছে।

এদিকে  বুধবার রাত ১০টায় দেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্টে তিস্তার পানিপ্রবাহ রেকর্ড করা হয়েছে ৫২ দশমিক ০৫ সেন্টিমিটার, যা বিপৎসীমার ১০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে (স্বাভাবিক ৫২ দশমিক ১৫ সেন্টিমিটার)। এর আগে বিকেল ৪টায় তিস্তার পানি এই পয়েন্টে ৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। বিকেল ৫টায় তা বেড়ে ১০ সেন্টিমিটার ও সন্ধ্যা ৬টায় ২০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। রাত ৭টা ও ৮টায় পানি বেড়ে ২৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে ও রাত ৯টায় পানি কমে বিপদসীমার ৫ সেন্টিমিটার নীচ দিয়ে প্রবাহিত হয়। অর্থাৎ রাত ৯টা থেকে পানি প্রবাহ কমতে শুরু করে। এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আসফাউদ্দৌলা।



এদিকে নদী বিশ্লেষকদের অভিযোগ, অভিন্ন নদী তিস্তার উজানে গজলডোবা ব্যারেজ নির্মাণ করে ভারত একতরফা পানি প্রত্যাহারই শুধু নয়, বর্ষামৌসুমে নিজেদের রক্ষায় পাহাড়ি ঢল ও বর্ষণের পানি ছেড়ে দিচ্ছে নির্বিচারে। শুধু তাই নয়, এই ঢল বা বন্যার আগাম খবরটুকুও বাংলাদেশকে জানায় না তারা। যে কারণে আচমকা বন্যায় ভিটে-মাটিসহ স্বর্বস্ব হারাচ্ছে দেশের উত্তর জনপদের মানুষ।

রংপুরের পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রবিউল ইসলাম বলেন, মডার্ন টেকনোলজির মাধ্যমে ভারত-বাংলাদেশ সুদৃঢ়ভাবে বা খুব দ্রুত তথ্যের আদান-প্রদান সম্ভব হলেই দুর্ভোগগুলো কিছুটা হলেও লাঘব হবে। হিমালয় থেকে নেমে আসা তিস্তা নদীতে সাড়ে ৪ লাখ কিউসেক পানি নিঃস্মরণ ক্ষমতার তিস্তা ব্যারেজ সেচপ্রকল্প বাংলাদেশ নির্মাণ করে উত্তরের জেলা লালমনিরহাটের দোয়ানীতে। আর এর ঠিক ৭২ কিলোমিটার উজানে ভারত সাড়ে ৬ লাখ কিউসেক পানি নিঃস্মরণ ক্ষমতার গজলডোবা ব্যারেজ নির্মাণ করে একতরফা ভাবে অভিন্ন এই নদীর পানি নিয়ন্ত্রণ করছে।   রংপুরের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোবাশ্বের হাসান বলেন, সতর্কীকরণ বার্তা অনুযায়ী বন্যাটি ভয়ংকর রূপ নিতে পারে। এ কারণে আমরা আগাম নদীপাড়ের লোকজনকে নিরাপদে সরিয়ে নেওয়ার জন্য চেষ্টা করছি। যেন একজনেরও প্রাণহানি না হয়। মালামালের ক্ষয়ক্ষতি না হয়। এছাড়াও পানি যতক্ষণ থাকবে, কতক্ষণ এই দুর্গত মানুষদের জন্য শুকনা খাবারসহ প্রয়োজনীয় খাবারের বন্দোবস্ত করে রাখা হয়েছে।